প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে অনলাইন পত্রিকার নির্ভরতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও ভবিষ্যৎ

প্রকাশঃ মার্চ ২১, ২০২৩ সময়ঃ ২:৩৯ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:৫৭ অপরাহ্ণ

কাকডাকা ভোরে সাইকেলে চেপে যে হকার প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকাটি দিয়ে যান পাঠকের দরজার সামনে; তা পড়বার মতো সময় এখন পাঠকের নেই। তাই দিনশেষে যখন রাত নামে তখন হঠাৎ চোখে পড়ে সকালের পত্রিকাটি। একপলক চোখ বুলিয়ে রাতের ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান সেই পাঠক; যে কিনা একসময় সকালের চা খেতে খেতে গভীর মনোযোগে ছাপা কাগজের পত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন। অথচ সেই  তিনিই এখন ওয়াইফাইয়ের বদৌলতে রাতে ঘুমোতে যান জুকারবার্গের নীল দেওয়ালের জালে ঘুরাঘুরি করতে করতে। যার সকালের ঘুমটাও এখন আর কোনো দোয়েল, টিয়া, ময়নার ডাকে; কিংবা হকারের সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজে ভাঙছে না; কারণ অনলাইনের মায়াজালেই আটকে পড়ছেন তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। 

২০১৪ সালের ১ লা নভেম্বরের একটি ঘটনা। সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ছিলো না ৮ ঘন্টা। সেদিন অনলাইন পাঠক সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। কারণ টেলিভিশন দেখতে না পাওয়ায় মোবাইলে অনলাইন পত্রিকা পড়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন পাঠকরা। বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার প্রতি নির্ভরতার একটি উল্লেখ্যযোগ্য দিন ছিলো সেটি।

সংবাদপত্রকে যদি বলা হয় তাড়াতাড়ির সাহিত্য; তাহলে অনলাইন সাংবাদিকতাকে বলতে হবে, অতি তাড়াতাড়ির সাহিত্য বা চলমান সাহিত্য।কারণ এখানে প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সময়ের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রতি মুহূর্তের আপডেট নিউজের সাথে ঐ নিউজ পোর্টালের পাঠকসংখ্যা, নিউজের শেয়ার সংখ্যা, লাইক সংখ্যা এবং পত্রিকাটির অ্যালেক্সা র‌্যাঙ্কিংসহ আরও অনেক সূচকই ওঠানামা করে।

অন্যদিকে দৈনিক সংবাদপত্রে আজকের সংবাদ আগামীকাল প্রকাশিত হয়। কিন্তু অনলাইন নিউজ পোর্টালের ক্ষেত্রে আজকের সংবাদ আজকেই এবং মুহূর্তের সংবাদ মুহূর্তেই প্রকাশ করতে হয়। ২০/২৫ মিনিটও এখানে অনেক দীর্ঘ সময়। আর অনলাইন পত্রিকার কাছে ছাপানো পত্রিকার পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এই তাৎক্ষণিকতার বিষয়টি।

দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের নিউজ পোর্টাল রয়েছে: ১. বিশেষায়িত নিউজ পোর্টাল (শুধু খেলা, শুধু বিনোদন, শুধু কৃষি, শুধু প্রযুক্তি। যেমন: ই-টেক, প্রিয় ডট কম, কৃষিকথা)। ২. ডেইলি ইভেন্ট নিউজ পোর্টাল ( দৈনন্দিন রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, শেয়ারবাজার, অপরাধ; মোটকথা প্রায় সব বিষয়ের সর্বশেষ। যেমন- বাংলা নিউজ, বিডি নিউজ ) ৩. বিশেষ সংবাদ ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল (অনেকটা অফ-ট্যাকের নিউজ।যেখানে ডেইলি ইভেন্ট নয়, বিশেষ প্রতিবেদনই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-বিবিসি বাংলা, ডয়েচে ভেলে)। ৪. মিশ্র নিউজ পোর্টাল (গুরুত্বপূর্ণ ডেইলি ইভেন্ট, বিশেষ সংবাদ এবং ফিচারের সমন্বয়। যেমন-প্রতিক্ষণ ডট কম, জাগো নিউজ)।

অনলাইন সাংবাদিকতায় সময় যেহেতু মূল বিবেচ্য বিষয়; সেহেতু অনলাইন সাংবাদিকদের খুব চাপের মধ্যেই কাজ করতে হয়। যেকোনো সংবাদ খুব দ্রুততার সাথে তাদের পাঠাতে হয়। এ কারণে একজন অনলাইন সাংবাদিকের নিউজ সেন্স, টাইপিং স্পিড এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের মাত্রা উচ্চতর পর্যায়ে থাকা দরকার। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে। যেমন- বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানো নিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একটা সংবাদ সম্মেলন; যেখানে অনেকক্ষণ ধরে তারা ব্রিফ করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে যদি আলোচনা হয় অথবা প্রশ্নোত্তর পর্বেও যদি রেগুলেটরি কমিশন বলেন, ‘ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২ টাকা করে বাড়ানো হচ্ছে’। তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে একজন অনলাইন সাংবাদিককে ফোন দিয়ে তা অফিসে জানিয়ে দিতে হয়।

আর খবরটি পাওয়ার সাথে সাথেই ঐ পত্রিকার সাব এডিটর নিউজটিকে লিড করে তিন-চার লাইনে দিয়ে দিলেন। যেমন- ‘বিদ্যুতের দাম আবারোও বাড়ানো হচ্ছে। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে এইমাত্র সিদ্ধান্তটি জানানো হয়’। মাত্র কয়েকটি লাইনে নিউজটি আপলোড করে বলে দেয়া হয় বিস্তারিত আসছে…। এরপর ব্রিফিং চলাকালীন সময়ে পুরো নিউজ স্টোরিটি লিখে ফেলেন একজন অনলাইন সাংবাদিক। ব্রিফিং শেষ হতে না হতেই তিনি স্পটে বসেই নিউজটি মেইলে পাঠিয়ে দেন। এদিকে অফিসের সাব এডিটর ঐ মেইলটি চেক করে কয়েক মিনিটের মধ্যে আগের অংশের সাথে সংযুক্ত করে নিউজটির বিস্তারিত আপলোড করে দেন সাইটে। যে পত্রিকা এই কাজটি যতটা দক্ষতা, দ্রুততার ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে তৈরি করে পাঠককে আগে দিতে পারছে; তার সফলতাও তত বেশি।

অনলাইনের আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, অনলাইনে সফলতা এবং ব্যর্থতার বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে জানা যায়। যেমন- কোনো নিউজ আপলোড করার পর গুগল অ্যানালাইটিক্স থেকে অনলাইন পোর্টাল কর্তৃপক্ষ সহজে জানতে পারে- এ পর্যন্ত ঐ নিউজটি কতজন দেখেছে? কোন কোন স্থান থেকে, কোন কোন দেশ থেকে কতজন দেখেছে। এমনকি মোবাইল থেকে কয়জন দেখছে, ডেস্কটপ থেকে কতজন, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের লিংক থেকে কয়জন দেখছে- এসব বিষয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়। যা অন্যান্য গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে একটু জটিল ও সময় সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে অনলাইন পত্রিকাগুলোর এডভান্টেজকে কল্পনাতীত বলা চলে। কারণ কোন ধরনের নিউজ মানুষ বেশি দেখছে, তার পছন্দ কী; এটা সহজেই জানতে পারছে অনলাইন পত্রিকা। আর চাহিদা অনুযায়ী নিউজ দেয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন তারা।

এছাড়া যেকোনো নিউজের ক্ষেত্রে এই মুহুর্তে ঐ নিউজে লাইক কেমন হচ্ছে, শেয়ার কেমন হচ্ছে, কমেন্ট কেমন আসছে; সর্বোপরি এর ভিজিটর সংখ্যা কত তাও জানা যাচ্ছে। আবার সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাইটে ভিজিটর বাড়ানোর কৌশলও অনলাইন পত্রিকা কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। মোটকথা, অনলাইনে ফিডব্যাক খুব দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে এবং পাওয়ার কৌশলও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব কারণে দ্রুত পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে বেশিরভাগ পাঠক নিউজ পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখান থেকে যেকোনো নিউজ পছন্দ হয়ে গেলে; তার লিংকে ক্লিক করে বিস্তারিত জানা যায় খুব সহজে। ইদানীং বাসে, রস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে অনেককে দেখা যায় ফেসবুক থেকে অনলাইন পত্রিকা পড়ে নিজেকে আপডেট রাখছে। আর পছন্দ হলে নিউজটি শেয়ার দিচ্ছে। অর্থাৎ চলতে-ফিরতেও মানুষ পত্রিকা পড়ছে। অ্যানড্রয়েড মোবাইলের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেট সুযোগসুবিধা অবারিত হওয়ার কারণে দিন দিন অনলাইন পত্রিকার পাঠক সংখ্যা বেড়েই চলছে। বর্তমানে ইন্টারনেট সহজলভ্যতার আরেকধাপ হল ওয়াইফাই। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা দিনরাত অনলাইনে পড়ে থাকছে। এসব কারণে সবদিক বিবেচনা করে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোও তাদের অনলাইন ভার্সনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রায় সকল শীর্ষ সংবাদপত্র এখন প্রিন্ট কপির পাশাপাশি অনলাইন সংস্করণ প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাঠকও এখন প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে অনলাইন মিডিয়ার দিকে বেশি ঝুঁকছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনের সবচেয়ে সুবিধা হলো তাৎক্ষনিক সংবাদ পরিবেশন। বর্তমানে পাঠক যেকোনো সংবাদ দ্রুত পেতে অধীর আগ্রহে ইন্টারনেটের আশ্রয়ও নেন। আমাদের গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ তৃণমূল সাংবাদিকতার যে দিকদর্শন দিয়ে গেছেন; প্রযুক্তির এ যুগে তা আরো বেশী কার্যকর হয়ে উঠছে। গ্রাম থেকে একটি সংবাদ পরিবেশন করতে কী পরিমাণ ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হতো; তা একমাত্র ভুক্তভুগী প্রতিনিধিরাই ভালো জানেন। অথচ এখন প্রযুক্তির বদৌলতে খুব সহজেই মূহুর্তের মধ্যে বিশ্বের যেকোনো স্থানে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রতিটি  খবর। গ্রামীণ সাংবাদিকতার আরেক দিকপাল মোনাজাত উদ্দিন কী কষ্ট করে কত জনের কাছে অনুরোধ করে ঢাকার পত্রিকা অফিসে সংবাদ পাঠাতেন; তা এখনকার জেলা প্রতিনিধিদের জন্য কল্পনা করাও বেশ কঠিন।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষ দ্রুত তথ্য জানতে চায়। তাই তারা অনলাইন মিডিয়ার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোনো একটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই মানুষ তা জানার জন্যে উদগ্রীব। টেলিভিশনে তা প্রচারের আগেই অনলাইনে সে খবর চলে আসছে। এজন্যই দেশ-বিদেশে অনলাইন সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অনলাইন পত্রিকার নিউজের সাথে অডিও ও ভিডিও ক্লিপস সংযোজন সংবাদের গুরুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে আরো বহুগুনে।

কথায় আছে, বর্তমান-ই আগামীর প্রতিচ্ছবি। তাই ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে; যখন প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্ব মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। একইসাথে অনলাইনে বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে সচেতন পাঠক হবে আরো বেশি আপোষহীন। যেসব পোর্টাল পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সবার আগে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিবে, তারাই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে; বাকীরা ছিটকে পড়বে। কেননা মূল প্রতিযোগিতা হবে এখানেই।

 

রাকিব হাসান

লেখক ও সাংবাদিক

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G